২০১৪ সালের ১৭ মে খুলনা শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশের একমাত্র গণহত্যা-নির্যাতন বিষয়ক জাদুঘর ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর।
আগামী ১৭ মে ২০১৮ তারিখে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার ৪র্থ বছর পূরণ হবে । এ উপলক্ষে ২৮ বৈশাখ ১৪২৫, ১১ মে ২০১৮ খুলনার বিএমএ ভবনে জাদুঘরের ৪র্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দিনব্যাপি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৭ মে ২০১৮ রমজান শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে কয়েক দিন আগেই অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়।
সকাল ১০টায় বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সাথে যৌথভাবে আয়োজন করা হয় গবেষক বন্ধন বা লেখক সম্মেলন। এত বড় কলেবরে মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের মিলনমেলা খুলনায় প্রথমবারের মত আয়োজন করা হয়েছে। দেশের সকল জেলা থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণায় অগ্রগণ্য গবেষকবৃন্দ উক্ত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনে বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর পক্ষ থেকে খুলনা অঞ্চলের ২৮ জন মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। যারা সম্মাননা পেয়েছেন তারা হলেন আসাদুজ্জামান আসাদ, রুকুনউদ্দৌলাহ, আনোয়ার হোসেন, ফখরে আলম, মহম্মদ আবদুল বারী, নূর মোহাম্মদ, পরেশ কান্তি সাহা, আফরোজা পারভীন, শামসুল হুদা, জাহিদ রহমান, দিলীপ কুমার মন্ডল, বিষ্ণুপদ বাগচী, মো : রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব, মোঃ এ হান্নান, রফিকুর রশীদ, মোহসিন হোসাইন, শংকর কুমার মল্লিক, অমল কুমার গাইন, হামিদুল হক মুন্সি, রণজিৎ চট্টপাধ্যায়, স. ম. বাবর আলী, মোল্লা আমীর হোসেন, হৈমন্তী শুক্লা কাবেরী, গৌরাঙ্গ নন্দী, ফাহিমা খাতুন, মো. রোকনুজ্জামান, মোহা : আবুল হোসেন এবং মো : আবুল কালাম আজাদ।
সম্মিলনী গবেষক বন্ধনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। অধ্যাপক মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। গবেষকবৃন্দের মধ্য থেকে আলোচনায় অংশ নেন ড.মাহবুবর রহমান, অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বিশিষ্ট গবেষক মামুন সিদ্দিকী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তপন পালিত, জাদুঘরের প্রধান নির্বাহী কাজল আব্দুল্লাহ প্রমুখ।
বক্তব্য শেষে সম্মানিত অতিথিবৃন্দ গবেষকদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ডা. শেখ বাহারুল আলম। সঞ্চালনায় ছিলেন চৌধুরী শহীদ কাদের।
বক্তৃতা অনুষ্ঠানে প্রারম্ভিক বক্তৃতায় বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নতুন জাগরণ প্রয়োজন। এখানে কোন নিরপেক্ষতার সুযোগ নেই। নতুন প্রজন্মের স্থানীয় পর্যায়ের গবেষকগণ গবেষণার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অজানা তথ্য উন্মোচন করবেন। সেখানে সম্মিলনী গবেষক বন্ধন একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।” অনুষ্ঠানে আহম্মেদ শরীফ সম্পাদিত ‘সম্মিলনী গবেষক বন্ধন’ স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
জাদুঘর প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে প্রতিবছর শহিদ স্মৃতি স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হচ্ছে। এবার ৪র্থবারের মত শহিদ স্মৃতি স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। ৪র্থ শহিদ স্মৃতি স্মারক বক্তৃতার বক্তা হিসেবে এবার উপস্থিত ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। এবারের বিষয় বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলন, বাঙালির রাষ্ট্র ভাবনা ও বঙ্গবন্ধু। স্মারক বক্তৃতাটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে কিছু অংশ তিনি পাঠ করেন।
বক্তৃতা শেষে মুনতাসীর মামুন-ফাতেমা ট্রাস্ট কর্তৃক দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদান প্রদান করেন ড. মুনতাসীর মামুন ও উপস্থিত অতিথিবৃন্দ। ফরিদপুর নগরকান্দা উপজেলার মোসা: মিনি বেগম, নূরজাহান বেগম ও মো: কলম শেখকে অনুদানের টাকায় ভ্যান প্রদান করা হয়। তাঁরা তিনজনেই মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালতে কুখ্যাত খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেন। মিনি বেগম ও নূরজাহান বেগম দুজনেই বীরঙ্গনা।
১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর সুহৃদ সভা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। ক বিভাগ (৬ষ্ঠ-৮ম) ও খ বিভাগ (৯ম-১০ম) দুটো দলে প্রতিযোগিতা সম্পন্ন হয়। রচনার বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা। উপস্থিত অতিথিবৃন্দ অংশগ্রহণকারী ও বিজয়ীদের মধ্যে সনদপত্র ও পুরষ্কার বিতরণ করেন।
অনুষ্ঠানের এ পর্বে মুক্তিযুদ্ধের কিছু অমূল্য স্মারক জাদুঘর কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করেন হেরিটেজ আর্কাইভস এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মো. মাহবুবর রহমান। তিনি কিছু দুষ্প্রাপ্য নথি জাদুঘরে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য প্রদান করেন। এর মধ্যে রয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের নিদের্শনামা, বিভিন্ন জেলার শান্তি কমিটির মিটিং এর মিনিটস, শান্তিসেনার হলফনামা, জেনারেল নিয়াজী কর্তৃক বাঙালীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের এক অমূল্য দলিল, রংপুরের কুখ্যাত পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী জেনারেল খটকের দুষ্কর্মের দলিল। এছাড়াও রয়েছে বাগেরহাট জেলার কুখ্যাত রাজাকার রজব আলী ফকিরের হাতে লেখা চিঠি যেখানে স্থানীয়দের শান্তি কমিটি বা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়ার আহবান জানানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আসল রেকর্ডিং অত্যন্ত দুর্লভ। ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের সংগ্রহের জন্য একটি রেকর্ডিং আর্কাইভ ৭১ এর প্রধান নির্বাহী প্রণব সাহা জাদুঘরকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। নড়াইল জেলার শহিদ মুক্তিযোদ্ধা মো. মতিয়ার রহমানের রক্তমাখা বস্ত্র, স্কুল আইডি কার্ড জাদুঘরকে প্রদান করেন তাঁর ছোট বোন শাহানাজ পারভীন। ভারতের ৫ নং ইয়ুথ ক্যাম্পের আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র ক্যাম্পের ডাক্তার বি এম মতিউর রহমানের কাছে সঞ্চিত ছিল। আজকে সেই মূল্যবান নথিপত্র জাদুঘরকে প্রদান করেন তাঁর পুত্র মুক্তিযোদ্ধা রছিকউর রহমান। তাঁরা সকলে নিদর্শনগুলো জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি ড. মুনতাসীর মামুন এর হাতে তুলে দেন।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র প্রযোজনায় প্রখ্যাত প্রণব সাহা বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানগুলো সংগ্রহ করে একটি তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন। নান্দনিক এ তথ্যচিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনীর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপনী ঘোষণা করেন অনুষ্ঠানের সভাপতি ড. মুনতাসীর মামুন।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ