সুন্দরবনের টেকসই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সমন্বিত গবেষণা জরুরি : উপাচার্য

সুন্দরবনের ওপর গবেষণায় অস্ট্রেলিয়ান সংস্থা ২০ কোটি টাকা সহায়তা প্রাদানে আগ্রহি

খ্যাতনামা গবেষক ও শিক্ষক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন এর বিশেষ উদ্যোগে আজ রবিবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ ভবনের সম্মেলন কক্ষে সুন্দরবনের উপর যৌথ ও সমন্বিত গবেষণার উদ্যোগ এবং অস্ট্রেলিয়ান গবেষণা সংস্থার সহায়তার অভিলক্ষে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

সেমিনারে উপস্থাপিত বিভিন্ন গবেষণা নিবন্ধ ও আলোচনায় উঠে আসে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ নানামুখী বৈরী অভিঘাত সত্ত্বেও সুন্দরবন আপন মহিমায় টিকে আছে। এর আয়তনও বাড়ছে। তবে গত ৫০-৬০ বছর বা ততোধিক সময়ের তথ্য-উপাত্ত বলছে- সুন্দরবনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন দৃশ্যমান।

লবণাক্ততা বৃদ্ধি সত্ত্বেও কোনো কোনো প্রজাতির (গেওয়া, গরানসহ) বৃক্ষ-গুল্মের বৃদ্ধির প্রবণতা আশাব্যঞ্জক অবস্থায় রয়েছে। আবার কোনো কোনো প্রজাতির (সুন্দরীসহ) উপর অনেকটাই বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ নির্বিচারে সন্নিহিত এলাকার নদী ও খালে চিংড়ির পোনা আহরণে মৎস্য প্রজনন, বিস্তার ও বংশ রক্ষায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠির বিকল্প কর্মসংস্থান, জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করা এবং এই ম্যানগ্রোভ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির ওপরও জোর দেওয়া হয়।

সুন্দরবনে পর্যটকদের আগমন বাড়ছে কিন্তু প্রকৃত অর্থে ইকো-ট্যুরিজম বলতে যা বোঝায় সেটা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। সুন্দরবনে পর্যটনে যেয়ে লাউড স্পিকার ব্যবহার করায় বন্যপ্রাণী ও পক্ষিকুলের আবাস, প্রজনন ও বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটছে।

অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচার রিসার্চ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সুন্দরবন বন বিভাগ, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য বিভাগ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, জিআইজেডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সুন্দরবন নিয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে গবেষণা, কার্যক্রম বাস্তবায়ন, উদ্যোগ ও পরিকল্পনা এবং তথ্য-তত্ত্ব তুলে ধরেন।

এ আলোচনায় সুন্দরবনের ওপর বৃষ্টিপাত, লবণাক্ততা ও তাপমাত্রার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। সেমিনারে সুন্দরবন নিয়ে চলমান প্রকল্পের বাস্তব চিত্র উপস্থাপন করা হয়। বন গবেষণা প্রতিষ্ঠানেরও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়।

সুন্দরবনের নতুন মানচিত্র ও সুন্দরবন মিউজিয়াম তৈরি এবং প্রাকৃতিক উপায়ে সুন্দরবন বহির্ভুত এলাকায় সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির চারা লাগিয়ে ইতোমধ্যে গত কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় ২ লাখ ৯ হাজার হেক্টর জমিতে বন সম্প্রসারণের অভূতপূর্ব সাফল্যের তথ্য তুলে ধরা হয়।

তাছাড়া সুন্দরবনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে মেরিন অভয়াশ্রম তৈরি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

সুন্দরবন নিয়ে নানা ভাবনা, উদ্যোগ, গবেষণা ফলাফল ও প্রকল্প বাস্তবায়ন চিত্র এবং ব্যবস্থাপনা, তথ্য-তত্ত্বের হালনাগাদ অবস্থাসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে ৪ ঘণ্টার আলোচনা হয়।

সেমিনারের সভাপতির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, সুন্দরবন নিয়ে নানামুখী গবেষণা হচ্ছে, নানা উদ্যোগ ও প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে, তথ্য-তত্ত্ব আহরণ করা হচ্ছে। তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে হওয়ায় অভিলক্ষ অর্জনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কাজ করতে যেয়ে সমস্যার সম্মুখীনও হতে হচ্ছে। তাই সময় এসেছে আর দেরি না করে সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা বা কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি সংস্থার যৌথ ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের। যাতে সকল সংস্থার মধ্যে আন্তঃসংযোগ, তথ্য-তত্ত্ব বিনিময় ও পরামর্শ-দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।

ইকোলজিক্যাল মডেলিং ও ডাটা এনালাইজিং করে ইকো সিস্টেম নিয়ে আরও বিশদ গবেষণা করা যায়। তিনি অস্ট্রেলিয়ান সরকারের প্রতিনিধিদের প্রতি বিশ্বসম্পদ সুন্দরবনের টেকসই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গবেষণা সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

অস্ট্রেলিয়ান প্রতিনিধি দলের প্রধান ড. নোরা ডেভো সুন্দরবন নিয়ে গবেষণায় সে দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার আগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলেন, ইতোমধ্যে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের ২০ কোটি টাকার গবেষণা সহায়তা প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যাপারে তিনি দৃঢ় আশাবাদী।

এর আগে সেমিনারে সূচনা বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন সুন্দরবন নিয়ে নিজের নানা গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সুন্দরবনের সব অংশের লবণাক্ততা এক রকম নয়, পলিস্থিতি ক্রম বিস্তারও এক নয়, পানি প্রবহের ধরন, মাটি গঠন ও তাতে জৈব উপাদানের উপস্থিতির তারতম্য রয়েছে। বিগত ৬০ বছরের বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও লবণাক্তার পরিমাণ বাড়ছে। সে কারণে বৃক্ষরাজির মধ্যে প্রজাতির ভিন্নতায় অভিযোজনের তারতম্য লক্ষণীয়। সুন্দরবনের কার্বন শোষণ ক্ষমতার ওপর আরও গবেষণার প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এসময় পাওয়ারপয়েন্ট উপস্থাপন করে আরও আলোচনা করেন অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচার রিসার্চের প্রতিনিধি ড. নোরা ডেভো এবং সংস্থার দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ড. প্রতিভা সিং, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. নাজমুল আহসান, অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জিয়াউল হায়দার ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড এনভারনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. স্বপন কুমার সরকার।

সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচার রিসার্চের প্রতিনিধি প্রফেসর অ্যান ফ্লেমিং, আইইউসিএন (এশিয়া অঞ্চল)’র সাবেক পরিচালক ড. জাকির হোসেন, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপ-প্রধান বন সংরক্ষক মো. জহির ইকবাল, বাংলাদেশ বন বিভাগের পক্ষে বিভাগীয় বন অফিসার (ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগ) নির্মল কুমার পাল, বিভাগীয় বন অফিসার (পশ্চিম) ড. আবু নাসের মহসীন হোসেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক মো. রাকিবুল হাসান সিদ্দিকী, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষে পাইকগাছা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক অফিসার ড. মো. লতিফুল ইসলাম,

সেমিনারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান স্কুলের ডিন প্রফেসর খান গোলাম কুদ্দুস, ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মো. গোলাম রাক্কিবু, ফিশারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রধান প্রফেসর ড. মো. গোলাম সরোয়ার, একই ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এ জেড এম মঞ্জুর রশিদ এবং দেশের শীর্ষ স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি সংস্থার শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী ও প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *